মহাভারত

মহাভারত সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্যের অন্যতম (অপরটি হল রামায়ণ)। এই মহাকাব্যটি হিন্দুশাস্ত্রের ইতিহাস অংশের অন্তর্গত।

মহাভারত-এর মূল উপজীব্য বিষয় হল কৌরব ও পাণ্ডবদের গৃহবিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি। তবে এই আখ্যানভাগের বাইরেও দর্শন ও ভক্তির অধিকাংশ উপাদানই এই মহাকাব্যে সংযোজিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ – এই চার পুরুষার্থ-সংক্রান্ত একটি আলোচনা সংযোজিত হয়েছে এই গ্রন্থে। মহাভারত-এর অন্তর্গত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা ও উপাখ্যানগুলি হল ভগবদ্গীতা, দময়ন্তীর উপাখ্যান, রামায়ণ-এর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠান্তর ইত্যাদি; তবে এগুলিকে মহাভারত-রচয়িতার নিজস্ব সৃষ্টি বলে মনে করা হয়।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মহাভারত-এর রচয়িতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। তিনি বেদ ব্যাখ্যা করেছিলেন বলে তাঁর অপর নাম ব্যাসদেব। অনেক গবেষক এই মহাকাব্যের ঐতিহাসিক বিকাশ ও রচনাকালীন স্তরগুলি নিয়ে গবেষণা করেছেন। অধুনা প্রাপ্ত পাঠটির প্রাচীনতম অংশটি মোটামুটি ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ রচিত হয়। মহাভারতের মূলপাঠটি তার বর্তমান রূপটি পরিগ্রহ করে গুপ্তযুগের প্রথমাংশে (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী)। মহাভারত কথাটির অর্থ হল ভরত বংশের মহান উপাখ্যান। গ্রন্থেই উল্লিখিত হয়েছে যে ভারত নামে ২৪,০০০ শ্লোকবিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্রতর আখ্যান থেকে মহাভারত মহাকাব্যের কাহিনিটি বিস্তার লাভ করে।

মহাভারত-এ এক লক্ষ শ্লোক ও দীর্ঘ গদ্যাংশ রয়েছে। এই মহাকাব্যের শব্দসংখ্যা প্রায় আঠারো লক্ষ। মহাভারত মহাকাব্যটির আয়তন ইলিয়াড ও ওডিসি কাব্যদ্বয়ের সম্মিলিত আয়তনের দশগুণ এবং রামায়ণ-এর চারগুণ।

মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে, মহর্ষি বেদব্যাস হিমালয়ের এক পবিত্র গুহায় তপস্যা করবার পর মহাভারতের সম্পূর্ণ ঘটনাটি স্মরণ করেন এবং মনে মনেই এর রচনা করেন। ব্যাসদেব চাইলেন এই মহান কাহিনি সিদ্ধিদাতা গণেশের দ্বারা লিপিবদ্ধ হোক। গণেশ লিখতে সম্মত হলেন, কিন্তু তিনি শর্ত করলেন যে, তিনি একবার লেখা শুরু করলে তার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাসদেবের আবৃত্তি একটিবারও থামতে পারবে না। তখন ব্যাসদেব বুদ্ধিমতো পাল্টা একটি শর্ত উপস্থাপনা করলেন – “গণেশ যে শ্লোকটি লিখবেন, তার মর্মার্থ না বুঝে লিখতে পারবেন না”। ভগবান গণেশ এই প্রস্তাব স্বীকার করলেন। এইভাবে ব্যাসদেব মাঝে মাঝে কিছু কঠিন শ্লোক রচনা করে ফেলতেন, যার ফলে গণেশকে শ্লোকটির অর্থ বুঝতে সময় লাগত এবং সেই অবসরে ব্যাসদেব তাঁর পরবর্তী নতুন শ্লোকগুলি ভেবে নিতে পারতেন। এইরূপে সম্পূর্ণ মহাভারত রচনা করতে প্রায় ৩ বৎসর লেগে যায়।

একমাত্র কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও কাশীরাম দাস ছাড়া আর কোনো বাঙালি কবি সম্পূর্ণ মহাভারত রচনার প্রয়াসী হননি।

পরাগল খান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) সেনাপতি ও চট্টগ্রামের শাসনকর্তা। চট্টগ্রামের জোবরা গাঁয়ে রাস্তিখান মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি (১৪৭৪ খ্রি.) থেকে জানা যায় তাঁর পিতা রাস্তিখান ছিলেন রুকনুদ্দীন বারবক শাহ এর অধীনে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা। আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম দখল করে পরাগল খানকে লস্কর পদে (সেনাপতি) নিয়োগ করেন। এজন্য তিনি ‘লস্কর পরাগল খান’ নামেও পরিচিত। তিনি ছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক। কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকরনন্দী তাঁদের কাব্যে উদাত্ত ভাষায় তাঁর প্রশংসা করেছেন। তাঁর নির্দেশে তাঁর সভাকবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর সংস্কৃত মহাভারত অবলম্বনে বাংলায় মহাভারত রচনা করেন। কবির নামানুসারে কাব্যটি কবীন্দ্র মহাভারত (আনু. ১৫১৫-১৫১৯) এবং পরাগলের নামানুসারে পরাগলী মহাভারত নামেও পরিচিত। কবিন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব টি রচনা করেননি। পরে এটি রচনা করেন শ্রীকরনন্দী।

ছুটি খান গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯) ও তৎপুত্র নাসিরুদ্দীন নুসরৎ শাহের রাজত্বকালে (১৫১৯-১৫৩২) চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের শাসনকর্তা। তাঁর পিতা পরাগল খান ছিলেন হোসেনশাহী আমলে চট্টগ্রামের সৈন্যাধ্যক্ষ ও প্রাদেশিক শাসনকর্তা (শের-ই-লস্কর) এবং পিতামহ রাস্তি খান ছিলেন সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ-এর রাজত্বকালে (১৪৫৯-১৪৭৪) চট্টগ্রামের শাসনকর্তা (মজলিস-ই-আলা)। ছুটি খান, তাঁর পিতা ও পিতামহ চট্টগ্রামের স্থানীয় অধিবাসী ছিলেন। তারা বংশ পরম্পরায় গৌড়ের সুলতানের প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন সেনাপতি হিসেবে চট্টগ্রামের শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। পিতা পরাগল খানের মতো ছুটি খানও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁরই নির্দেশে রাজসভার কবি শ্রীকর নন্দী সংস্কৃত মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বটি বাংলা পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে অনুবাদ করেন (১৫১৮-১৫২০)। তাই এটি ‘ছুটি খানি মহাভারত’ নামে পরিচিত।

কাশীরাম দাস মহাভারতের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় অনুবাদক। তিনি সতের শতকের কবি। তিনি সম্পূর্ণ মহাভারত অনুবাদ করেননি। পরে তাঁর ভাইয়ের ছেলে ও আরো কয়েকজন মিলে তা শেষ করেন। কাশীরাম দাসের মহাভারতের দুটি বিখ্যাত পঙক্তি

মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস ভনে শোনে পুণ্যবান।।

Add a Comment