বাংলা লিপি সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে জীবিকা অর্জনের জন্য একটি ছাপাখানা খোলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের জন্য অনেকগুলি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এগুলি হল এরকম:

  1. সংস্কৃতের “य” বর্ণটি বাংলায় “য” হরফ দিয়ে লেখা হত, কিন্তু শব্দে অবস্থানভেদে এর উচ্চারণ “জ” কিংবা “য়”-এর মতো উচ্চারিত হত। বিদ্যাসাগর “জ” উচ্চারণের ক্ষেত্রে “য” বর্ণটি ব্যবহার এবং “য়” উচ্চারণের ক্ষেত্রে “য”-এর নিচে ফুটকি দিয়ে নতুন বর্ণটি ব্যবহারের প্রস্তাব করেছিলেন।
  2. একইভাবে “ড” ও “ঢ”-এর নিচে ফুটকি দিয়ে বিদ্যাসাগর “ড়” ও “ঢ়” হরফ দুইটির প্রচলন করেছিলেন।
  3. বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষায় অব্যবহৃত “দীর্ঘ-ৠ” ও “দীর্ঘ-ৡ” বর্ণ দুইটি বর্জন করেছিলেন। তবে কেবল “ঌ” বর্ণটিও বাংলায় অব্যবহৃত ছিল, কিন্তু বিদ্যসাগর এ নিয়ে কিছু বলেননি।
  4. এছাড়া সংস্কৃত স্বরবর্ণমালার অন্তর্গত অনুঃস্বর (ং), বিসর্গ (ঃ), এবং চন্দ্রবিন্দু (ঁ) যেহেতু প্রকৃতপক্ষে ব্যঞ্জনবর্ণ সেহেতু বিদ্যাসাগর এই বর্ণগুলিকে ব্যঞ্জনবর্ণমালার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ব্যঞ্জনবর্ণ হলেও যেহেতু এগুলি স্বতন্ত্র বর্ণ নয়, অযোগবাহ বর্ণ সেহেতু কোন বাংলা অভিধানেই বিদ্যাসাগরপ্রণীত বর্ণক্রমটি গৃহীত হয়নি।
  5. বিদ্যাসাগর “ণ-ন” এবং “শ-ষ-স”-এর মধ্যে উচ্চারণের সমতা সম্ভবত লক্ষ্য করলেও এর কোন সংস্কার করেন নি।

বিদ্যাসাগর বাংলা হরফের স্বচ্ছতা ও সমতা বিধানের জন্যও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন:

  1. তিনি যফলাকে ব্যাঞ্জনের সাথে যুক্ত করে কমলার কোয়ার মতো না লিখে আলাদা করে লেখার ধারা চালু করেন। ফলে সর্বত্র যফলার আকার একই রূপ পেল।
  2. বিদ্যাসাগরের আগে ঋ-কার ব্যঞ্জনের তলে বিভিন্ন রূপে বসত। বিদ্যসাগরই প্রথম ব্যঞ্জনের নিচে পরিস্কারভাবে “ৃ” চিহ্নটি বসিয়ে লেখা চালু করেন। একইভাবে হ্রস্ব-উ কারের জন্য “ু” লেখা চালু করেন।
  3. কিন্তু বিদ্যাসাগরের সংস্কারগুলি সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। অনেকগুলি অস্বচ্ছ যুক্তব্যঞ্জনের চিহ্ন অস্বচ্ছই থেকে গিয়েছিল। যেমন – “তু” “ত”-এর নিচে উ-কার দিয়ে লেখা হলেও “ন্তু”, “স্তু” যুক্তাক্ষরগুলিতে পুরনো অস্বচ্ছ রূপটিই থেকে গেল।

ইংরেজি বিচল হরফগুলি একটি ডালায় দুই খোপে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সাজানো থাকত। কিন্তু বাংলায় এ নিয়ে তেমন কোন চিন্তা হয় নি। বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা হরফের জন্য ডালার একটি নকশা এবং কোন হরফের পর কোন হরফ বসবে তার নিয়ম স্থির করে দেন। তাঁর এই নকশাই ক্রমে সমস্ত বিচল হরফ ব্যবহারকারী বাংলা ছাপাখানাতে গৃহীত হয়। বাংলা মুদ্রণশিল্পে প্রতিষ্ঠিত হয় সমতা। বিদ্যাসাগর বাংলা মুদ্রণশিল্পকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। মূলত তার বেঁধে দেয়া নিয়মনীতি অনুসারেই পরবর্তী একশো বছর, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলা হরফ মুদ্রিত হয়।

সময়ের সাথে বিদ্যাসাগরীয় হরফের সামান্য কিছু পরিমার্জনের চেষ্টাও করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর নিজে বর্ণপরিচয়-এর ৬০তম সংস্করণ থেকে শব্দের শেষে অন্তর্নিহিত ও উচ্চারণযুক্ত ব্যঞ্জন, যেমন- “বিগত”, “কত” শব্দের শেষের “ত”-টা, যেন “ৎ”-এর মত উচ্চারণ না হয়, সেজন্য এগুলির উপর তারাচিহ্ন দেয়া প্রবর্তন করেন। বিংশ শতাব্দীতে অনেক লেখক একই কাজে ঊর্ধ্বকমা (‘) ব্যবহার করেছেন, যেমন- একশ’, ইত্যাদি। তবে এই সংস্কারটি সর্বজনগৃহীত হয়নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরী হরফের দুই ধরনের এ-কার (মাত্রাছাড়া ও মাত্রাসহ) দুইটি ভিন্ন কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। তিনি শব্দের শুরুর মাত্রাযুক্র এ-কার দিয়ে “অ্যা” ধ্বনি বুঝিয়ে ছাপানো শুরু করেন। তবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য বেশির ভাগ প্রকাশকই এই রীতিটি গ্রহণ করেনি।


👉 Read More...👇

Add a Comment